মীলাদুন্নবী দেশে দেশে

মীলাদুন্নবী দেশে দেশে
সউদী আরব  যারা বলেন সউদী আরেবর পবিত্র হারামাইনিস শরীফাইন তথা মক্কা মুয়াজ্জমা ও মদীনাতুল মুনাওয়ারাতে মিলাদ মাহিফল এর অনুষ্ঠান উদযাপিত হয় না, তারা হয় মিথ্যা কথা বলেন না হয় জেনে শুনে সত্য গোপন করেন।
সবার আগে জেনে নিন মিলাদের ব্যাপারে ওহাবীদের গুরু হাফিয ইবনে তাইমিয়া (১২৬৩খৃঃ - ১৩২৮খৃঃ) কী বলেছেন? তার বিখ্যাত কিতাব ইক্তিদা আল সিরাতে মুস্তাকীমএ লিখেছেন, “আর কিছু লোক নাসারাদের অনুকরণে মীলাদুন্নবী মাহফিলের নামে বাড়িয়ে দিয়েছে, যেমন তারা ঈসা (আঃ) এর জন্মদিনে করে থাকে। আর যদি
মিলাদ মাহফিল নবী (দঃ) এর প্রতি ভালবাসা ও সম্মান প্রদর্শনের জন্য করা হয়ে থাকে তবে আল্লাহ এ মুহাব্বত ও সম্মান প্রদর্শনের কারণে সওয়াব বা প্রতিদান দেবেন।” (পৃঃ ৩১৩)।একই কিতাবের অন্যত্র তিনি লিখেছেন, “বরং ঐ দিনে (রাসুলের (দঃ) জন্মদিনে) পরিপূর্ণরূপে অনুষ্ঠান করা এবং এ দিনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা, উত্তম নিয়ত এবং হুজুরে পাক (দঃ) এর প্রতি মুহাব্বত প্রদর্শন বড় প্রতিদানের কারন হবে।” (পৃঃ ৩১৫)। এ প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, “খৃষ্টানদের যীশু খৃষ্টের জন্ম উৎসব পালনের সাথে প্রতিযোগীতা করে, কিংবা মহানবীর (দঃ) প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসার বশবর্তী হয়ে এমন কিছু কেউ উদ্ভাবন করে থাকে, যা তার পূর্ব পুরুষেরা করেনি, যদিও তার পশ্চাতে যুক্তি আছে, তবে সেটা খারাপ দিক নয়।’’ (পৃঃ ২৬৬)।
ওহাবীদের ধর্মীয় নেতা মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহাব নজদী (১৭০৩খৃঃ - ১৭৯২খৃঃ) তার কিতাব মুখতাসার সিরাতে রাসুলএ রাসুলে কারিমের (দঃ) পবিত্র জন্মের সুসংবাদ শুনে আবু লাহাব কতৃক মনের খুশীতে নিজ দাসী সুইয়াইবিয়াহ কে মুক্তি দেয়ার কারনে দোযখে তার শাস্তি হ্রাসের বিষয় উল্লেখ করে মিলাদুন্ননবী পালনের গুরুত্বের কথা স্বীকার করেন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, তিনি শামসুদ্দীন নাসের দামিস্কির কিতাব মওরদুস সাদী ফি মওলদিল হাদীথেকে এ ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন এবং সেখানে দামিস্কির (রহঃ) রচিত শেরটিও হুবহু উদ্ধৃত করেছেন।
মক্কার পবিত্র মসজিদুল হারাম শরীফের সাবেক খতীব ও বরেণ্য আলেমে দ্বীন আল্লামা সাইয়েদ মুহাম্মদ বিন আলভী আল মালেকী আল হাসানী সাহেবও মিলাদ শরীফ পালনের বৈধতা ও বরকত প্রসঙ্গে স্বীয় জোরালো অভিমত ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু বর্তমানের সৌদী আরবের নজদীরা, বিন বাজরা এটা স্বীকার করে নিতে নারাজ।
এবার আমি পবিত্র মক্কা নগ‌রীতে মিলাদুন্নবী উদযাপনের কয়েকটা প্রমান উল্লেখ করছি :
১। বিখ্যাত হাফেযে হাদীস আবুল ফয়েজ আবদুর রহমান ইবনুল জাওযী (রহঃ) তাঁর কিতাবে লিখেছেন, “হারামাইন শরীফ, মিশর, ইয়ামন, সিরিয়া এবং পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত আরবের সকল শহর নগেরর অধিবাসীগনের মধ্যে অব্যাহতভাবে এই নিয়ম চলে আসছে যে, তাঁরা হুযুর পাকের (দঃ) মীলাদের অনুষ্ঠান করেন।রবিউল আউয়ালের নতুন চাঁদের আগমনে উল্লাসিত হন, গোসল করেন, দামী পোষাক পরেন, নানা প্রকার সাজ-সজ্জা করেন, সুগন্ধি ব্যবহার করেন, সুরমা লাগান।রবিউল আউয়ালের এই দিনগুলিতে তারা আনন্দ উৎসব করেন, হাতের সম্পদ টাকা-পয়সা মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দেন এবং অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে মীলাদ শরীফ পাঠ ও শ্রবণের ব্যবস্থা করে অধিক সওয়াব ও বিরাট সাফল্য অর্জন করেন।দুররুল মুনাজ্জাম’-পৃঃ ৮৫।
২। সুবিখ্যাত ফকীহ, হানাফী মাজহাবের অন্যতম ইমাম মোল্লা আলী কারী হানাফী মক্কী (রহঃ) স্বীয় প্রসিদ্ধ কিতাব আল মৌরেদুর রাবী ফি মৌলদিন্নবীতে লিখেছেন, “সদা সর্বদা সমস্ত ইসলামী রাষ্ট্রসমূহ ও বড় বড় শহরের মধ্যে হুযুর (দঃ) জন্মদিবসের খুশিতে বড়ই জাঁকজমকের সাথে পালিত হয়ে আসছে
৩। হাফেযে হাদীস আবুল খায়ের ছাখাবী (রহঃ) বলেন, ‘মক্কা মোকাররমায় কয়েক বছর ধরে মিলাদ শরীফের অনুষ্ঠানে শরীক হবার এবং তার বরকত লাভ করার সৌভাগ্য যারা লাভ করেছিলেন আমিও তাদের মাঝে একজনআল মৌরেদুর রাবী ফি মৌলদিন্নবী’ - মোল্লা আলী কারী হানাফী (রহঃ)।
৪।হযরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভীর (রহঃ) (১৭০৩ খৃঃ-১৭৬২ খৃঃ) পিতা হযরত শাহ আবদুর রহীম দেহলভী (রহঃ) তাঁর ফুয়ুযুল হেরেমাইনকিতাবে মীলাদে শরীক হবার কথা উল্লেখ করে বলেন, “আমি একবার হুজুরে পাক (দঃ) এর জন্মের তারিখে মক্কা মুয়াজ্জমার সেই ঘরে হাজির ছিলাম, যেখানে হযুরের (দঃ) শুভ জন্ম হয়েছিল। লোকজন হযুরের (দঃ) উপর দুরুদ পাঠ করছিলেন, হযুরে পাকের (দঃ) জন্ম সময়কার এবং নবুয়ত প্রকাশের আগেকার আশ্চর্য ও অলৌকিক ঘটনাবলী বর্ণণা করছিলেন, এমন সময় হটাৎ দেখতে পেলাম নুর চমকাচ্ছে। আমি এ নুরগুলোর প্রতি ধ্যান করলে বুঝতে পারলাম এটা সে সমস্ত ফেরেশতাদের নুর যারা এ ধরণের মজলিসে উপস্থিত হন।আমি আরো দেখতে পেলাম যে, ফেরেশতাদের নুরসমূহ রহমতের নুরের সাথে মিশে যাচ্ছে
৫। তারীখে হাবীবে ইলাহপুস্তকের লেখক মুফতি এনায়েত আহমদ সাহেব লিখেছেন, “মক্কা-মদীনা শরীফ এবং অধিকাংশ ইসলামী শহরে প্রচলন হলো রবিউল আউয়াল মাসে মীলাদ শরীফের অনুষ্ঠান করা। মুসলমানদেরকে জমায়েত করে হুজুরে পাক (দঃ) এর জন্মের আলোচনা করা, দরুদ শরীফ বেশী বেশী করে পাঠ করা, দাওয়াতী খানা অথবা শিরণী বিতরণ করা। এ কাজটি অনেক বরকতের কারন হয় এবং এর দ্বারা হুজুরে পাক (দঃ) এর সাথে মুহাব্বত বাড়ে। ১২ রবিউল আউয়াল তারিখে মদীনা মুনাওয়ারার মসজিদে নববীতে এ বরকতময় মাহফিলটি অনুষ্ঠিত হয়। আবার মক্কা মুয়াজ্জমায় হুজুরে পাক (দঃ) এর জন্মের স্থানেও। সুতরাং মুসলমানদের উচিত, হুজুরের (দঃ) মু্হাব্বতের তাগিদে যেন মীলাদ অনুষ্ঠান করেন।
৬।দেওবন্দীদের ওলামাদের সর্বজনমান্য পীর হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী সাহেব (১৮১৭ খৃঃ -১৮৯৯ খৃঃ) তাঁর সুবিখ্যাত কিতাব ফয়সালা হাফত মাসআলাতে নিজে মিলাদ-কিয়াম এর অনুষ্ঠান করা এবং কিয়াম এর মধ্যে আনন্দ লাভ করার কথা লিখেছেন। তাঁর সুদীর্ঘ মক্কী জীবনেও এ নিয়ম অব্যাহত থাকাটাই স্বাভাবিক।
বর্তমানে মক্কা ও তার আশেপাশের এলাকার প্রায় ৩০ টা জায়গায় নিয়মিতভাবে সাপ্তাহিক ও মাসিক ভিত্তিতে কিয়াম সহকারে মিলাদ মাহফিল করা হয়। বাংগালী ছাড়াও আরবী, পাকিস্তানী, ভারতীয় এবং অন্যান্য মুসললিম দেশীয় লোকগন ঐসব মাহফিলে অংশ নেন।
আনজুমানে খুদ্দামুল মুসলীমিন, মক্কা” “গাউছিয়া কমিটি বাংলাদেশ, মক্কা শাখাএবং আল্লামা নুরুল ইসলাম হাশেমী সাহেবের সংগঠন আনজুমানে মুহিবানে রাসুল-গাউছিয়া জিলানী কমিটি মক্কাপ্রতি মাসে মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করে থাকেন।
১। রুসাইফায় রয়েছে বিশ্ব বরেণ্য আলেম, আওলাদে রাসুল হযরত আল্লামা শায়খ সৈয়দ আহমদ মালেকীর (মা.জি.আ.) খানকাহ। সেখানে নিয়মিতভাবে মিলাদ-কিয়ামের মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।পবিত্র হারাম শরীফ থেকে প্রায় ৩-৪ কিলো মিটার পশ্চিমে বাংগালী অধ্যুষিত মিসফালার শেষ প্রান্তে অবস্থিত আবাসিক এলাকা রুসাইফার এমন দু-একটা মিলাদ মাহফিলে গত ২০১১ সালে হজ্জের সময় আমি নিজে আরো অনেক বাংগালী হাজী সাহেবানদের নিয়ে হাযির হয়েছিলাম। বাংলাদেশি ছাড়াও সেখানে বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশের লোকজন এসে থাকেন।

উল্লেখ্য, আরব দেশীয় আ‌য়োজকদের সবাই অভিজাত শ্রেণীর সৌদী নাগরিক। এদের মাঝে বেশ কয়েকজন আওলাদে রাসুল ও আছেন। যেমন ১। মক্কার আরো একজন গণ্যমান্য সৌদী নাগরিক আওলাদে রাসুল এবং মক্কার উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও বিশিষ্ট গবেষক সৈয়্যদ মুহাম্মদ ইবনে আলভী।
২ । আল্লামা জায়েদ আহমদ বিন আলাঊয়ি। ১৯৯৫ সালে তিনি আল্লামা হাশেমি সাহেবকে মোজাদ্দেদিয়া-নক্সবানদিয়া তরীকার খিলাফাত দিয়েছেন। তিনি শায়খে ফাদাক নামেও পরিচিত।
৩। আল্লামা সৈয়দ আব্বাস আলঊয়ী মহল্লা : আযিযীয়া। প্রতি শনিবার মাহফিল হয়। খতমে কুরআন, কসীদায়ে বুরদা পাঠ, জিকির আলোচনা, কিয়াম মুনাজাত এবং সবশেষে তবাররুক বিতরণ করা হয়। ইনি নিজের সবকিছু মাহফিলের জন্য ওয়াকফে লিল্লাহ করে দিয়েছেন।
এছাড়া আল্লামা রাদান ও শায়খ জাফর জামালুলাইল এর দরবারেও মিলাদ কিয়ামের মাহফিল আয়োজিত হয়ে থাকে। মক্কা ও তার কাছাকাছি আরো যে সব জায়গায় মিলাদ মাহফিলের অনুষ্ঠান করা হয় সেগুলো হচ্ছে : কাকিয়া, নাওজাহা, হাঊলাই সিত্তিন।
মদীনা মুনাওয়ারায় মিলাদ-কিয়াম:
পবিত্র মদীনা মুনাওয়ারায় মিলাদ-কিয়াম অনুষ্ঠানের কথা ইতিপূর্বে ইবনুল জাওযী ও মুফতি এনায়েত আহমদ সাহেবের লেখায় এসেছে, তাই আবার নতুন করে তাঁদের উক্তির পুনরুল্লেখ করলামনা।
১। শাহ মুহাম্মদ ইসহাক দেহলভীর স্থলাভিসিক্ত উসতাদুল উলামা হযরত শাহ আবদুল গনী মুহাদদিসে দেহলবী মুহাজিরে মাদানী (রহঃ) এর শিষ্য শাহ আবদুল হক এলাহাবাদী লিখেছেন, “আমাদের শায়খ ও মুরশীদ হযরত মাওলানা শাহ আবদুল গনী সাহেব নাক্সবন্দী মুজাদ্দেদীকে আমি দেখেছি, মদিনায় রবিঊল আউয়াল মাসের ১২ তারিখে রবিবার দিনে মসজিদে নববীতে মীলাদ শরীফের অনুষ্ঠানে তিনি শরীক হন এবং মসজিদে নববীর আঙ্গিনায় মিমবরে বসে একের পর এক ইমামগণ রওযা শরিফের দিকে মুখ করে হুজুরে পাকের (দঃ) জন্মের যে আলোচনা করছিলেন তা শুনেন। কিয়ামের সময় সবার সাথে কিয়ামও করেন।এ পবিত্র মাহফিলে যে রকম হাল ও বরকত প্রকাশ পেয়েছিল, তা বলার ভাষা নেই।
২। আল্লামা মু্হাম্মদ সালেহ (রহঃ) এর বরাত দিয়ে আলা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খান বেরেলভী (রহঃ) (১৮ খৃঃ -১৯২১খৃঃ) বলেন, “আরব, মিসর, সিরিয়া, রুম, আন্দালুস ও সকল মুসিলম দেশসমুহে নবীজীর সকল উম্মত ঐক্যমত পোষণ করেছন যে, মিলাদ শরীফ পাঠে কিয়াম করা মুসতাহাব ও মুসতাহসান।” ‘ইকামাতুল কিয়ামাহ আলা তা-ইিনল কিয়াম
৩। দেওবনদী, ওহাবী‌, তাবলীগীদের পরম পূজনীয় মাওলানা রফীউদ্দীন সাহেব তারিখে হেরামাইনকিতাবে লিখেছেন, “নবী করীম (দঃ) এর মিলাদ বা বিলাদাত শরীফ বর্ণনার মুহুর্তে কিয়াম করা ঐ সমস্ত আলেম মুসতাহসান বা উত্তম আমল বলেছেন যারা হলেন যুগের মুহাদ্দিস ও ফকীহ।
৪। পবিত্র মদিনা মুনাওয়ারার বিখ্যাত আলেম ও ওয়াকফ মন্ত্রণালয়ের প্রধান শায়খ শরীফ ফুয়াদ মারয়ী বিগত ১০-১২-২০০১ ইং তারিখে এশিয়ার বৃহত্তম দ্বীনী শিক্ষাকেন্দ্র জামেয়া আহমদীয়া সুন্নীয়ার প্রধান ফকীহ মাওলানা মুফতি সৈয়দ অছিয়র রহমান সাহেবকে এক একান্ত সাক্ষাতকারে আমাদের দেশসহ অন্যান্য অনেক মুসলিম দেশে নুর নবীজীর শুভাগমনের মাসে অনুষ্ঠিত মিলাদ মাহফিল, খানা-পিনার আয়োজন ইত্যাদির বৈধতার ব্যাপারে আভিমত ব্যক্ত করে বলেন, “এগুলো উত্তম ও ভাল, আমি নিজেই আপনাদের দেশে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাহফিলে যোগদান করেছি।সূত্র- মাসিক তরজুমান, ডিসেম্বর মাহে জিলহজ্ব ১৪২২, ফেব্রু-মার্চ ২০০২ সংখ্যা। পৃঃ ৬৮-৬৯।
৫।কুতুবে মদিনা হযরত সৈয়দ জিয়াউদ্দীন মাদানী (রহঃ) (১৮৭৩ খৃঃ ১৯৮৪ খৃঃ ) - হযরত সৈয়দ জিয়াউদ্দীন মাদানী (রহঃ) ছিলেন আলা হজরত, ইমামে আহলে সুন্নত আহমদ রেজা খান বেরলবীর (১৮৫৬ খৃঃ -১৯২১ খৃঃ) বিশিষ্ট মুরীদ ও খলীফা।হযরত সৈয়দ জিয়াউদ্দীন মাদানী (রহঃ) বর্তমানে বহুল প্রচারিত মাদানী কাফেলাখ্যাত দাওয়াতে ইসলামীর আমীর মাওলানা আবু বিলাল মুহাম্মদ ইলিয়াস আত্তার কাদেরী সাহেবর পীর।ইসলামের প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাদি) এর বংশধর।হযরত সৈয়দ জিয়াউদ্দীন মাদানী (রহঃ) ১৮৭৩ খৃঃ শিয়ালকোট এ জন্মগ্রহন করেন। লাহোর ও দিল্লীতে শিক্ষা সমাপন করার পর ১৮৯৭ খৃঃ (২৪ বছর বয়সে) তিনি আলা হযরত ইমামে আহলে সুন্নাত হযরত শাহ আহমদ রেজা খান বেরলবী (রহঃ) এর নিকট বাইয়াত হন।প্রখ্যাত মুহাদ্দিস হযরত সুরতী সাহেবের নিকট তিনি হাদীস শাস্ত্র শিক্ষা লাভ করেছিলেন। অতঃপর তিনি উচ্চ শিক্ষার্থে বাগদাদ চলে যান।সেখানে তিনি হযরত গাউসে পাকের (রহঃ) দরবারে প্রায় ১০ বছর কাল উচ্চ শিক্ষা ও রিয়াজত সাধনায় অতিবাহিত করেন।এরপর ১৯০৬ খৃঃ তিনি মদিনা মুনাওয়ারায় হিজরত করেন ।
পবিত্র মদীনা তাইয়্যেবার মসজিদে নববী শরীফের কাছাকাছি খানকাহ স্থাপন করে দ্বীনের খিদমতে রত হন। তিনি কুতুবে মদিনানামে খ্যাত ছিলেন। তাঁর দরবার ছিল বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাসুল প্রেমিকগনের মিলনমেলা। সেখানে প্রতিদিন বাদ নমাজে মাগরিব মিলাদ-কিয়ামের অনুষ্ঠান পরিচালিত হতো। তিলাওয়াতে কুরআন, কসীদায়ে বুরদা পাঠ, জিকির, আলোচনা, কিয়াম মুনাজাত এবং সবশেষে তবাররুক বিতরণ করা হতো। অধম লেখক ১৯৭৩ খৃঃ ডিসেম্বর মাসে পবিত্র হজ্বের সফরে আমার পরম শ্রদ্ধেয় পিতা ঢাকা আনজুমান কমিটির সহ সভাপতি আলহাজ্ব এম সিরাজুল ইসলাম সওদাগর সাহেবের সাথে মদীনা শরীফে অবস্থানকালে বেশ কয়েক বার কুতুবে মদীনা হযরত সৈয়দ জিয়াউদ্দীন মাদানীর (রহঃ) দরবারে হাজির হয়ে তাঁর সাক্ষাৎ ও দোয়া লাভের সৌভাগ্য লাভ করেছি। সেখানে সালাতে সালামের সময় মুস্তফা জানে রহমত পে লাখো সালামএর সুমধুর ধ্বণী আজো আমার কানে বাজে।
হযরত সৈয়দ জিয়াউদ্দীন মাদানী (রহঃ)১১১ বছর বয়সে ১৯৮৪ খৃঃ মদীনায় ওফাত লাভ করেন। এ হিসেবে তাঁর মাদানী জিন্দেগীর হায়াত ছিল ৭৭ বছর। ইন্তেকালের পর জান্নাতুল বাকী শরীফে জান্নাতী রমণীকূল সরদার সাইয়্যেদা ফাতিমা যাহ্‌রার (রাদিঃ) মাযারের দুই গজের কাছাকাছি স্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়েছে। প্রতি বছর ৪ঠা জিলহজ্জ তারিখে এ মহান ব্যাক্তিত্বের ওরস উদযাপিত হয়।
হযরত সৈয়দ জিয়াউদ্দীন মাদানীর (রহঃ) সাথে আমার শ্রদ্ধেয় পীর ও মুরশীদ বিংশ শতকের
বিশিষ্ট সংস্কারক হযরতুল আল্লামা আলহাজ হাফেজ সাইয়্যেদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্‌র (রহঃ) (১৯১৬ খৃঃ -১৯৯৩ খৃঃ) সখ্য ছিল। পত্র যোগে উভয়ে যোগাযোগ রাখতেন। আবার মুরীদানদের মাধ্যমে তাঁরা পরস্পর উপহার ও বিনিময় করতেন। আমার মরহুম পিতাও ছিলেন হুজুর কিবলা সাইয়্যেদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্‌র (রহঃ) মুরীদ। তিনি প্রায় ১০ -১২ বার হজব্রত পালন করার সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন। হুযুর কিবলার (রহঃ) নির্দেশে বেশ কয়েকবার কুতুবে মদীনা (রহঃ) সাহেবের তিনি তোহফা বিনিময়ও করেছেন।

৬। মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ডঃ। রিদোয়ান সাহেবের বাসায় নিয়মিতাবে মিলাদ- কিয়ামের আয়োজন করা হয়। পাকিস্তানী, ভারতীয়, বাংলাদেশী ও সৌদী নাগরিকগণ এ অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহন করেন।
এছাড়াও মদীনা মুনাওয়ারার বিভিন্ন অলি-গলিতে নিয়মিতভাবে মিলাদ ও কিয়ামের অনুষ্ঠান পরিচালিত হয়ে থাকে যার বিস্তারিত বিবরণ দেয়া এখানে সম্ভব নয়। এখানে আমি শুধুমাত্র পবিত্র নগরী মদিনায়ে তায়্যিবার দুটা সংগঠনের নাম উল্লখ করছি যাদের পরিচালনায় প্রতি মাসে নবীজীর শহরে বেশ কয়েকটি মিলাদ ও কিয়ামের অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়ে থাকে -আনজুমানে খুদ্দামুল মুসলীমিন, মদীনা” “গাউছিয়া কমিটি বাংলাদেশ, মদীনা শাখা

আফ্রিকার দেশ সমুহে মীলাদুন্নবী উদযাপনঃ
১। মিশর প্রাচীন সভ্যতার দেশ মিশর। নীলনদের দান মিশর। হযরত মুসা (আঃ) হযরত হারুন (আঃ) সহ আরো বহু আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের পবিত্র পদধূলি ধন্য মিশর। ইসলামী কৃষ্টি- সংস্কৃতি শিল্প সাহিত্য স্থাপত্য শৈলীর বিকাশের উর্বরা ভূমি মিশর। এখানে রয়েছে মুসলিম বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম বিদ্যাপীঠ আল আযহারফাতেমী বংশীয় খলীফা আল মুঈয লিদ্বীনিল্লাহর নির্দেশে ৯৭৫ খৃষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে। এদেশে আরো রয়েছে কারবালার অমর শহীদ হযরত ইমাম হোসায়ন রাদিঃ এর পবিত্র মস্তক শরীফের মাজার, অসংখ্য অলী-বুযুর্গ ও আহলে বাইতের মাজার, ঐতিহাসিক বিভিন্ন স্থাপনা, সুউচ্চ মিনারা শোভিত কয়েক হাযার মসজিদ।মদীনা শরীফের পর মিসরের কায়রো ও আলেকজান্দ্রিয়ায় সর্বাধিক সংখ্যক আহলে বাইতের রাসুলুল্লাহর (দঃ) মাজার অবস্থিত। জুমার দিনে এ সকল জায়গায় প্রচুর লোক সমাগম হয়ে থাকে।
নুর নবীজীর (দঃ) সময়ে আফ্রিকার দেশ আবিসিনিয়ার খৃষ্টান রাজা নাজ্জাশি ছিলেন এখানকার শাসক। মুসলমানদের প্রতি তাঁর মনোভাব সবসময় ছিল নমনীয় ও সহানুভূতিশীল। নুর নবীজীর নির্দেশে কুরাঈশদের অত্যাচার কবলিত মুসলমানদের কাফেলা আবিসিনিয়া হিজরতও করেছিলেন।

এরপর ইসলামের দিত্বীয় খলীফা হযরত ওমর ফারুকর (রাদিঃ) সময়ে ২১ হিজরী মুতাবিক ৬৪২ খৃঃ মিশর বিজিত হয়। এর নায়ক ছিলেন বীর সেনাপতি হযরত আমর ইবনুল আস (রাদিঃ)। সেই তখন থেকেই মিশর সুন্নী মুসলমানদের এক গৌরবময় আবাসভূমি হিসেবে ইতিহাসে ঠাঁই করে নিয়েছে। যদিও মাঝে মাঝে এই ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েছে। কিন্তু বীর মিশরবাসীরা সত্যকে বরণ করে নিতে কক্ষনো ভুল করেনি। মিশরের জনসংখ্যার ৯৪% সুন্নী মুসলমান। উল্লেখ্য, মিশর সুদীর্ঘ প্রায় সাত শতাব্দীকাল ধরে সুন্নী মতাদর্শ ভিত্তিক ঐতিহ্য লালন করে আসছে। বর্তমানের ইউরোপ ও আমেরিকার সমর্থিত রাজনৈতিক দল মুসলিম ব্রাদারহুডএর আন্দোলন মূলতঃ উবিংশ শতকের সংস্কারপন্থী লেখক ও রাজনীতিবিদ শেখ মুহাম্মদ আবদুর ভাবধারার পুনরুজ্জীবন।শেখ আবদু ইবনে তাইমিয়ার মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। মিশরের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসনী মুবারাকের (১৯৮১ খৃঃ -২০১১খৃঃ) ইসলাম প্রিয় ও সহনশীল মনোভাবের সুযোগ নিয়ে গত কয়েক বছর ধরে মিশরে কট্টরপন্থী মুসলিম ব্রাদারহুডসংগঠনটি বৈদেশিক শক্তির প্রত্যক্ষ সাহায্য সহযোগীতা নিয়ে বর্তমানে বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।
মিশরে সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হলেন, শায়খুল আযহার, যিনি আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান। প্রেসিডেন্টের পরেই তাঁর স্থান।বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর মতামত অগ্রগণ্য। পদাধিকারবলে শায়খুল আযহার সমগ্র মিশরের প্রধান ও জাতীয় ইমাম। কায়রোর বিখ্যাত আল আযহারী মসজিদে তিনি জুমুয়ার নামাজের খুতবা দিয়ে থাকেন।এই জুমুয়ার নামাজের সকল কার্যক্রম সরাসরি রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হয়।
২০০২ সালের ডিসেম্বর মাসে নারিন্দার পীর সাহেবের আওলাদ বর্তমান গদীনশীন পীর জনাব আলহাজ্জ হযরত মাওলানা শাহ্‌ মোহাম্মদ আহসানুজ্জামান সাহেবের নেতৃত্বে বাংলাদেশ থেকে ৮ জনের একটা দল মিশর সফরে যান। দলের অপরাপর সদস্যরা ছিলেন - জনাব আলহাজ মোহাম্মদ ইসমাইল মিয়া (সিলেটের সাবেক জেলা ও দায়রা জজ বর্তমানে আহসানিয়া ইনস্টিটিউট অব সূফীজম এর পরিচালক), যশোরের তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ জনাব আলহাজ শামীম মোহাম্মদ আফজাল (বর্তমানে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক), রাজবাড়ীর তৎকালীন জেলা ও দায়রা জজ জনাব আলহাজ শেখ সাইদুল ইসলাম, যশোর জমিয়তুল মোদাররেসিনের সভাপতি মাওলানা মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম সহ আরো বেশ কয়েকজন। আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনকালে তাঁরা শায়খুল আযহার ডঃ মুহাম্মদ সাইয়্যেদ আত তানতাবীর সাথে দেখা করেন। পারস্পরিক আলাপকালে শায়খুল আযহার তাঁদের কাছে বাংলাদেশে প্রচিলত পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবীর আনুষ্ঠানিক উদযাপনের কথা শুনে সন্তোষ প্রকাশ করে মিশরেও রাষ্ট্রীয়ভাবে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপনের সংবাদ জানান। তিনি বলেন, “এটা অতি মুবারাক ও পুণ্যময় অনুষ্ঠান
প্রমান স্বরূপ আমি এখানে ১২ মে, ২০০৩ খৃঃ মিশরের সুপ্রীম কাউন্সিল ফর ইসলামিক এফেয়ার্স এর পঞ্চদশ ও সাধারন সম্মেলনে আগত সুধী ও অভ্যাগতদের উদ্দেশ্যে মিশরের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসনী মুবারাক (১৯৮১ খৃঃ -২০১১খৃঃ) কর্তৃক ইংরেজিতে প্রদত্ত রাষ্ট্রীয়ভাষণের অংশ বিশেষ উদ্ধৃত করছি দেখে আসুন মিশর পৃঃ ১৮৪
মিশরের আরেকজন সম্মানিত ও পরম শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি হলেন গ্র্যান্ড মুফতী।ইসলামী বিষয়ে তাঁর ফতোয়া চূড়ান্তরূপে গণ্য। শুধু মিসরেই নয়, সারা মুসিলম জাহান জুড়েও এই দুই ব্যক্তি সর্বজনমান্য। ২০০২ সালে গ্র্যান্ড মুফতী ছিলেন ডঃ আহমদ মুহাম্মদ আত তাইয়্যব।সাক্ষাৎকালে তিনিও পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপনের বিষয়ে মাননীয় শায়খুল আযহার সাহেবের অনুরূপ মন্তব্য করেন।
পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপনের ব্যাপারে মিশরের আরেকজন গ্র্যান্ড মুফতীর অভিমত মাসিক তরজুমানর ফেব্রুয়ারি ২০১১ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে (পৃঃ২৬-২৯)। তিনি বলেছেন, “পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন করা অতি উত্তম কাজ।’’
১। মালাউয়ী - আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিনে অবস্থিত মালাউই-তে হযরত মুহাম্মদ (দঃ) এর জন্ম ও ওফাত দিবস মুসলিম ও খৃষ্টান সম্প্রদায় একসাথে পালন করেছে। এই উপলক্ষে যে শোভাযাত্রা বের হয় তাতে স্থানীয় খৃষ্টান সম্প্রদায়ের লোকও সামিল হন। এমনকি বিভিন্ন চার্চেও এই দিনে হুযুর পাককে (দঃ) নিয়ে আলোচনা হয়। খৃষ্টান কর্তৃপক্ষ শেখ আমানান কিংওবে কে এই তথ্য দেন। শেখ আমানান কিংওবে ইসলামডটনেট ওয়েব সাইটে এই তথ্য দেন। তিনি আরো বলেন, “খৃষ্টান নেতারা তাঁকে বলেছেন- এই ধরণের কাজের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে তারা ইসলাম এবং এর ভিত্তি সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতে পারবেন। মালাউই সেকুলার রাষ্ট্র। মুসিলম হল এখানে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ। রাসুল পাক (দঃ) এর জন্ম ও ওফাত দিবসকে উপলক্ষ করে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন হল তা অন্য দেশের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে এবং মুসলিম-খৃষ্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেক ভুল বোঝাবুঝির অবসানকল্পে অনুকরণীয় হিসেবে কাজ করবে।
সূত্র দৈনিক ইত্তেফাক, শুক্রবারের সাপ্তাহিক ক্রোড়পত্র ধর্মচিন্তা পৃঃ ২৪, ২০ মার্চ, ২০০৯।
২। মরক্কো আফ্রিকার অন্যতম মুসলিম দেশ মরক্কোতেও প্রিয়নবীর (দঃ) এর জন্মদিবস প্রতিপালিত হয়ে থাকে। এ উপলক্ষে ঐদিন সরকারী ও বেসরকারি সব অফিস আদালত ছুটি থাকে। তাঁরা এ দিনটিকে ইয়াওমে বিলাদাতহিসেবে খুব ভক্তি- শ্রদ্ধার সাথে উদযাপন করে। সর্বত্র যিকিরে মিলাদবা নুর নবীজীর (দঃ) শুভাগমনের আলোচনা মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। দুরুদ সালাম ও তাবাররুক বিতরণ করা হয়। সূত্র মাসিক তরজুমান, ফেব্রুয়ারী ২০১১ সংখ্যা, পৃঃ ১৩।


Written by

We are Creative Blogger Theme Wavers which provides user friendly, effective and easy to use themes. Each support has free and providing HD support screen casting.

0 comments:

Post a Comment

© 2013 iPRESS. All rights resevered. Designed by Templateism